আতাকাঠী
আমার বিরহ আমি নিজেই বুনেছি তা
জানো ভালো করে তুমি আমার গাঁওয়ের মাটি,
আমার শব্দ আমি তোমার পিঠেতে রাখি
ভাত খাই, গান গাই, ঘুমের বাতাস মাখি
আমার হৃদয় আমি শান্ত করেছি বুকে
বিছায়ে তোমার বোনা হোগল পাটি।
ব্যক্তিগত কোন স্বর্গ আমার নাই, আবদ্ধ হইনি কোন হুরির প্রেমে
তবু স্বর্গ আমার প্রতীক্ষায় নত করে মাথা আছে আতাকাঠী গ্রামে।
আমার বাল্য তোমার বুকে, গীত গাওয়া সকালের শীতের কাঁপন
তোমার উদগ্র স্তন চিড়ে আমার অপক্ক যৌবনের বীজ বপন।
তুমি যাই হও আবদ্ধ চির আমি ঋনের প্রেমে
আমার স্বর্গ পরে আছে বুকের কপাট খুলে আতাকাঠী গ্রামে।
আতাকাঠী — ২
খোয়াবে আমি দেখেছি আমার গ্রামে
ছায়ার পেছনে হাঁটে ডাহুক—চড়ুই
যতটা স্বপ্ন আমি তৈরী করেছি ধানে
গাছে হাসে পেকে যাওয়া ‘আপেল বড়ই’
পায়লার ফুলেফুলে মৌমাছি ওড়ে
মধুর পরিস্রাবণ ভাদ্রের তালে
মহুয়ার রসে কারো মাথা গেলে ঘুরে
নেশাতুর মাছ ঘোরে খেজুরার খালে
যায় জলে ভেসে যায় নারকেল পিঠা
রসের হাঁড়িতে হাসে বাদুড়ের মুখ
সমস্ত পোকারা রসের হাঁড়িতে সাঁটা
মরেও তৃষ্ণা মেটানো প্রকৃত সুখ
আমি জানি আজানের পরের কথা
শীতের রাতে চাদরে মোড়ানো বাবা
দূরন্ত উমে হাসে মায়ের বানানো কাঁথা
এক ডালে দুলে হাসে শিশিরে জবা।
কেউ কি মনে রেখেছো সেসব স্মৃতি —
যাত্রায় জাদু কোমড়ে উমা বৌদি?
পালাগান, থিয়েটারে রঙের বাতি?
আজীবন বয়ে চলা পায়রা নদী?
আতাকাঠী -৩
আমাকে যত অকৃতজ্ঞ ভাবোনা কেন
আমি কৃতজ্ঞ হই মায়ের আঁচলে
যে গ্রামে আমি সব স্বপ্ন দেখেছি জানো
ঘুম ভেঙে উঠেছি খুব সকালে
সে গ্রামে খুঁজেছি মায়ের আঁচল
কোথাও পাইনি তা কাক ভোরে
খুঁজেছি সে আঁচল উঠান দড়িতে
মাঠে-ময়দানে আর খালের গভীরে
মক্তবে কোরানের সেসব সূরায়
টান দিয়েছিলো ভোরে মাহদী ইমাম
আমিও সেসব সূরার শেষ পারায়—
খুঁজেছি টানে টানে আমার পয়গাম
কত যে খোঁজার পরেও নাবালক দ্বীন
ফিরে ফিরে গিয়েছি মায়ের কবরে
জানো, এই আঁচলটা আমি পেতেই চাই
আবার উঠবো জেগে ভেবে কাকভোরে।
আতাকাঠী ৪
মেঠোপথ সদ্ভাবে চলে গেছে দূরে
এখানে কোকিল ডাকে আজানের সুরে,
এখানে মাতাল পাখি মহুয়ার ডালে
ডাকে প্রিয়তম বউ মুগ্ধ গলে।
কুয়াশারা উঁকি দেয় শীতের সকালে
সোনার দুপুরে সবে ভাতঘুমে গেলে
দিবাকর স্নানে যায় শেষ বিকেলে।
শরতে ঘাসের বাঁশি সুমধুর সুর
সুরেসুরে মোহিত সরণির দূর...
কবিতা শানিত হয় তীব্র বর্ষণে
বরষা নৃত্য করে বাড়ির উঠোনে;
ব্যাঙের ঘ্যাঙরঘ্যাঙে সারা পারা মাত
মোহের রজনী যেন বরষার রাত!
আমনের ক্ষেতে সজীব কৃষকের প্রাণ
তীব্র ধোঁয়ার তেজে ছড়ায় পিঠার ঘ্রাণ।
নতুন উদ্যমে বেরোয় আমের মুকুল
মৌমাছি সঙ্গমে আন্দোলিত বকুল
পাতা-ফুলে অর্ধমৃত বিষ পিঁপীড়া
তবু মায়া বয়ে চলে আকন্দ ফুলেরা
প্রকাশ্য কালনাগিনী কালো ধুতুরা
মনোহর তবু দেখো গাছেগাছে এরা!
গাবগাছে ঝুলে থাকে মৌমাছি চাক
পানা জলে খেলা করে পাতিহাঁস ঝাঁক।
ডালে বসে 'কা' ডাকে কালো পাতিকাক,
বিপন্ন বৃষ ছাড়ে গগনবিদারী ডাক!
তাল গাছে খেলা করে বাবুইয়ের দল
টিয়া পাখি ঠোঁটে কাটে কামরাঙা ফল
টিয়াদের ঠোঁটে আসে নতুন সকাল
খালেবিলে নৃত্যে মাছেদের দল।
ঘুঘু ডাকে দ্বিপ্রহর হিজল গাছে
নীরস শিমুল তুলা বাতাসে ভাসে।
আজানে মুখরিত উষসী বেলা
নতজানু গাছেরা বাজায় বেহালা
রাতের বৃহৎ চাঁদ স্মরি মধুমালা
নির্মেঘ গগনে তারার খেলা।
এখানে যা দ্যাখো মধু, তুমি আমার গ্রাম
গ্রাম আমার নিজ মায়ের আরেকটি নাম।
4/16/19
পরিমার্জনঃ ৮/৬/২১